আশাবরী

বাবার কোনো খোঁজ নেই। মাঝে মাঝে ডুব দেয়া তাঁর পুরনো অভ্যাস। বাবার ব্যবসা যখন খারাপ চলে, যখন সংসারে টাকা পয়সা দিতে পারেন না তখন উধাও হয়ে যান। তাঁকে নিয়ে আমরা তেমন চিন্তিত ও নই। কিছুদিন পর ফিরে আসেন। কিছুদিন বাইরে কাটিয়ে ফিরলেই বাবা সবাইকে নিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটায় গুরুত্ব দিতে থাকেন। তিনি আজ বিকেলে নিউ মার্কেট থেকে কাতল মাছের বিশাল মাথা নিয়ে এলেন। সেই মাথার মুড়িঘণ্ট রান্না হল। রান্নার সময় বাবা পর্যবেক্ষকের দায়ীত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন এবং মাকে নানান উপদেশ দিতে লাগলেন-"একটু ঝোল ঝোল রাখ।শুকনো হলে খেয়ে আরাম পাওয়া যাবে না। কয়কটি আলু কুচি কুচি করে কেটে দাও-আলু গলে ঝোলটা ঘন করবে, খেতে আরাম হবে। পাঁচ ফোরণ আছে? এক চিমটি পাঁচ ফোরণ ডোজ দিয়ে দাওনা- সুন্দর গন্ধ হবে। গোটা পাঁচেক আস্ত কাঁচামরিচ দিয়ে দাও কাঁচামরিচেরর সুঘ্রাণ তুলনাহীন।"

রান্নার এক ফাঁকে মা আমাকে আর আপাকে চুপি চুপি বলে গেলেন, মাছের মাথাটি পচা ছিল।খেতে ভাল হবেনা। তোর বাবাকে কিছু বলিস না। মনে কষ্ট পাবে। বেচারা শখ করে কিনেছে।
খাবার সময় মোটামুটি করুণ দৃশ্যেরর অবতারণা হল বলা যেতে পারে। বাবা নিজেই মাছ মুখে দিতে পারলেন না। ভাইয়া ফিরল রাত দেড়টায়। রাতে খাবারের মেনু কী জিজ্ঞেস করলে বললাম, "মাছের মুড়িঘণ্ট। বাবা নিজে মাছের মাথা কিনে আনলেন।"
ভাইয়া শুনেই বলল-"নিশ্চয় পচা ছিল। আজ পর্যন্ত বাবা কোনোদিন টাটকা মাথা কিনতে পারেন নি। একশ টাকা বাজি রেখে বলতে পারি-মাছের মাথাটি ছিল পচা তোরা কেউ খেতে পারিস নি।"
পচা মাছের মাথা খেয়ে আমাদের কিছু হল না। বাবার পেট নেমে গেল, সেই সঙ্গে যুক্ত হল বমির উপসর্গ। বাবা ক্ষীণস্বরে বললেন, "বাঁচবো না রে বাঁচবো না।আমার দিন শেষ।"

বাবার এই ঘোষণায় আমরা কেউ বিচলিত হলাম না। সামান্য অসুখেই তিনি এই জাতীয় ঘোষণা দেন যা মাকে খুব কাবু করে ফেলে। মা এবারো খুব কাবু হয়ে পড়লেন। ভাইয়াকে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, একটি ভালো ডাক্তার আন। মানুষটা মরে যাচ্ছে দেখছিস না?
ভাইয়া সহজ গলায় বলল, "চিন্তার কিচ্ছু নেই। বাবার শরীর থেকে পচা মাছের সর্বশেষ অংশটি বের না হওয়া পর্যন্ত দাস্ত এবং বমি হতে থাকবে। কাজেই চুপ করে বসে থাক। কাল পরশুর মধ্যে দেখবে বাবা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছে।"
ডাক্তার আনতে হলনা।বাবা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন বরিশাল যাবার জন্যে। বরিশাল থেকে সুপারি কিনে আনতে হবে। এটিই না-কি ঠিক সময়। শরীর পুরোপুরি না সারতে বাবা বরিশাল যাবার ব্যাবস্থা করে ফেললেন। আমরা সবাই প্রবল আপত্তি করলাম।
তিনি বললেন,"আমি তো আর সাঁতার দিয়ে যাবো না। লঞ্চে করে যাব। ডেকে বিছনা করে হাওয়া খেতে খেতে যাবো।" বাবার সবগুলি প্যান্ট ঢিলা হয়ে গেছে। পিছলে পড়ে যায়। বেল্ট নেই। কাজেই পাজামার দড়ি দিয়ে প্যান্ট পরা হল। তিনি এক হাতে স্যুটকেস এবং অন্য হাতে দু'বাটির টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বিকাল চারটায় রিক্সায় উঠে বসলেন।
"চারদিনের মাথায় চলে আসব।খুব বেশী হলে এক সপ্তাহ।চিন্তার কোনো কারণ নেই।আল্লাহ হাফেজ।"


আশাবরী

No comments:

ফেসবুক প্লাগইন তৈরি করেছেন শূন্য পেজ অ্যাডমিন হুমায়ূন আহমেদ

Post a Comment