মধ্যাহ্ন

জুলেখার ঘরে অতিথি এসেছে। আলাভোলা চেহারা, গায়ে চাদর। পরনে লুঙ্গি। রঙিলা বাড়িতে লুঙ্গি পরে কেউ আসেনা।
অতিথি বললেন, আপনার নাম কী?
জুলেখা বলল, সবার প্রথম প্রশ্ন আপনার নাম? নামের কি প্রয়োজন? আমার নাম ফুলবিবি হলে ও যা চানবিবি হলেও তা, আবার জুলেখা হলেও ক্ষতি নাই। মনে করেন আমার নাম জুলেখা। পান খাবেন? ভালো জর্দা আছে। ময়মনসিংহের সাধুবাবা জর্দা।
অতিথি বললেন, পান খাব।
জুলেখা পানদান এবং পিকদান পাশে এনে রাখল।
অতিথি বললেন, জুলেখা, শুনেছি তোমার কণ্ঠস্বর মধুর।আমি দূরদেশ থেকে এসেছি তোমার গান শুনতে। বাদ্যবাজনা প্রয়োজন নাই। খালি গলায় গান করবে, আমি শুনব। তুমি উকিল মুনসির গান ভালো জানো বলে শুনেছি। তাঁর একটি গান শোনাও।
-তাঁর গান আইজ গাব না।
-তাঁর গান গাবা না কেন?
-যেদিন আমার মন ভালো থাকে না, সেইদিন উনার গান করি।
অতিথি বললেন, আমি তোমার কাছে উনার গান শুনতে এসেছি। অন্য গান না। 
-কত টাকা এনেছেন?
-বিশটি রুপার টাকা এনেছি। চলবে?
-হ্যাঁ চলবে।

জুলেখা গান ধরল-
"আমার গায়ে যত দুঃখ সয়
বন্ধুয়ারে করো তোমার মন যাহা লয়
নিঠুর বন্ধুরে
বিচ্ছেদের বাজারে গিয়া
তোমার প্রেম বিকি দিয়া
করবনা প্রেম আর যদি কেউ কয়
ও বন্ধুরে।"
জুলেখার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। চোখের কাজল পানিতে ধুয়ে ধুয়ে যাচ্ছে। তার ফর্সা মুখে তৈরি হচ্ছে কালো রেখার আঁকিবুকি।

গান শেষ করে জুলেখা বলল, আরো কি গাইব?
অতিথি বললেন, বিশটা রুপার টাকায় যে কয়টি গান হয় সেই কয়টি গান শোনাও।
জুলেখা বলল, উকিল মুনসির একটি গানের দাম এক কলসি সোনার মোহর।
অতিথির ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসির আভাস দেখা গেল। তিনি দ্রুত সেই হাসি মুছে ফেলে বললেন, তোমার ঘরে ঢোল তবলা কিছু থাকলে আমারে দাও, গানের সঙ্গে তাল দেই। তাল বিনা গানন গাইতে তোমার অসুবিধা হইতেছে। আচ্ছা থাক লাগবেনা।
জুলেখা হাসিমুখে বলল, উকিল মুনসির গান পিয়ার করেন?
-হুঁ।
জুলেখা দ্বিতীয় গান ধরল-
"রজনী প্রভাত হলো ডাকে কোকিলা
কার কুঞ্জে ভুলিয়া ভুলিয়া......"
অতিথি বললেন, ভুলিয়া ভুলিয়া হবে না।হবে ভুলিয়া রহিলা।

জুলেখা বলল, আপনার পরিচয় কী?
অতিথি বলল, আমার নাম উকিল মুনসি।
জুলেখার ঘরে যেন বজ্রাঘাত হলো। কিছুক্ষণ নিস্পলক তাকিয়ে থেকে হিন্দুদের প্রণামের ভঙ্গিতে জুলেখা উকিল মুনসি পায়ে মাথা রাখল। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
উকিল মুনসি বললেন, তোমার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। আমি তোমাকে দোয়া দিলাম।
জুলেখা বলল, কী দোয়া দিলেন?
সব কিছু তোমাকে ছেড়ে গেলেও গান কোনোদিন ছেড়ে যাবে না।
[মধ্যাহ্ন]

No comments:

ফেসবুক প্লাগইন তৈরি করেছেন শূন্য পেজ অ্যাডমিন হুমায়ূন আহমেদ

Post a Comment