অদৃশ্য মানবের বর্ষবরণ - হুমায়ূন আহমেদ

বর্ষবরণ এবং ছায়ানট এখন সমার্থক। দিনের শুরু ছায়ানটের গান দিয়ে। সূর্য ওঠার আগে রমনা বটমূল লোকারণ্য। ছোট বাচ্চাদের কেউ মায়ের হাত ধরে এসেছে, কেউ এসেছে বাবার ঘাড়ে চেপে। বটগাছের পাখিরা কিচিরমিচির করে অস্থির। প্রতিবছর এই দিনে কিছু একটা হয়, এটা এখন পাখিরাও জানে। তারা অপেক্ষা করে কখন গাওয়া হবে-
'এসো হে বৈশাখ এসো এসো-

তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে।'
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে যাইনি। কিছু কিছু অনুষ্ঠান আমার টিভির পর্দায় দেখতে ভালো লাগে। যেমন: ক্রিকেট খেলা, বর্ষবরণ উৎসব, একুশের মধ্যরাতে শহীদ মিনারে পুষ্পদান। নিজে উপস্থিত না হয়ে টিভিপর্দায় অনুষ্ঠান দেখার আসল মজা অদৃশ্য হয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা। আমার অদৃশ্য মানব হতে ভালো লাগে।
দুই বছর আগে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, পহেলা বৈশাখে অদৃশ্য মানব হওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমি তখন সুইডেনে।
সুইডেনের কোনো টিভি চ্যানেল নিশ্চয়ই রমনা বটমূলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দেখাবে না। মনটা খুবই খারাপ হলো, মনে হলো আচমকা বাঙালির মূল স্রোতের বাইরে চলে গেছি। তখন খবর পেলাম সুইডেনে 'চ্যানেল আই' দেখা যায়। রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান তারা সব সময় প্রচার করে। মূল স্রোতে ভেসে থাকা এখন সম্ভব। সেদিনের অনুষ্ঠান দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমি চ্যানেল আইকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।

এ বছর কী হলো বুঝতে পারছি না। চ্যানেল আই স্ক্রলে দেখাচ্ছে, তাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে তারা বর্ষবরণ উৎসব দেখাতে পারছে না। চ্যানেল আইকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এ অনুষ্ঠান শুধু বিটিভি প্রচার করতে পারবে। আর কেউ নয়।


ঘটনাটা কী? রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান এখন সর্বজনীন অনুষ্ঠান। কারও ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান না। শুধু সরকারি টিভি বিটিভি এ অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারবে, আর কেউ পারবে না, কারণটা কী? ইউরোপে যেসব বাঙালি থাকেন, তাঁরা এবার কিছু দেখবেন না? বিটিভি ওই সব দেশে নেই।

ছায়ানট ভবন নামের বিশাল ভবনটি কিন্তু জনগণের টাকায় বানানো। ছায়ানটের কর্মকর্তাদের টাকায় নয়। জনগণের একটি বড় অংশ প্রবাসী বাঙালি। আজ তাঁদের কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে?
যাঁরা বিদেশে থাকেন, তাঁদের প্রকৃতি চিলের মতো। চিল আকাশে ওড়ে, তার দৃষ্টি থাকে মাটিতে। প্রবাসীরা বিদেশে বাস করেন, তাঁদের মন পড়ে থাকে দেশে। দেশে কী হচ্ছে, তা নিয়ে তাঁদের সীমাহীন আকুলতা।

রমনা বটমূলের চমৎকার অনুষ্ঠানটি তাঁদের অনেকেই দেখতে পারবেন না। তাঁদের দুঃখবোধ কি ছায়ানটের কর্মকর্তাদের স্পর্শ করবে? তাঁরা গভীর আবেগে গাইবেন,
'তোমায় আমায় মিলন হলে সকলই যায় খুলে 
বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে উঠে তখন দুলে।'
গানের বাণী তাঁরা বিশ্বাস করেন কি? তাঁদের চেতনায় কি 'বিশ্বসাগর' আছে? (ইংরেজিতে বলি, 'I doubt that.')

-হুমায়ূন আহমেদ

No comments:

ফেসবুক প্লাগইন তৈরি করেছেন শূন্য পেজ অ্যাডমিন হুমায়ূন আহমেদ

Post a Comment