এই ক্ষুদ্র দেশটির অবস্থান ভারতের পূর্বে। দেশটির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। ট্রপিক্যাল জোনের বেনানা বেল্টে এর অবস্থান।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের জনগোষ্ঠীর নব্বই শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে দুর্নীতি সম্পর্কযুক্ত। দুর্নীতিতে শীর্ষ সূত্রে প্রায় প্রতিবারই এই দেশের নাম আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে (বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা) আছে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ। যেমন- জঙ্গি মৌলবাদ। এরা দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে প্রায়ই তারা বোমাবাজি করে। দেশটিতে আমেরিকার মতোই প্রধান দুটি দল। পরস্পরের প্রতি এদের আচরণ অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ। যে দল ক্ষমতায় থাকে না, তার প্রধান লক্ষ্য থাকে হরতাল দিয়ে দেশকে অচল করে দেওয়া। হরতাল মানেই দোকানপাট, গাড়ি ভাঙচুর।
গাড়ি ভাঙা এই দেশের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি তুচ্ছ কারণে এরা শত শত গাড়ি ভাংচুর করে। আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী কর্মীরা এ ধরনের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে কখনো হস্তক্ষেপ করেন না।
দেশটির আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। র্যাব নামের একটি সংস্থা এ দেশে আছে, তারা যে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। তার জন্য তাদের জবাবদিহিতার ভেতর দিয়ে যেতে হয় না। এসব হত্যাকাণ্ডের নাম ‘ক্রসফায়ার’। সঙ্গত কারণেই এদের পোশাক ফাঁসির জল্লাদদের পোশাক। তারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য কালো চমশা পরে এবং কালো রুমালে মাথা ঢেকে রাখে।
দেশ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দেওয়া হলো। এখন এই দেশের রাজধানী ঢাকা শহরের মানুষদের বর্ষবরণ উৎসব পালনের কথা বলব। শুরুতেই বলে নিচ্ছি এই দেশটিতে সরকারিভাবে কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয় না। এই ক্যালেন্ডারের ব্যবহার বিভিন্ন উৎসবের দিন নির্ধারণে। বাংলা ক্যালেন্ডারে নববর্ষ হলো বৈশাখের প্রথম দিন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এপ্রিলের ১৪ তারিখ।
দিনটি ছিল অসম্ভব গরম। তাপমাত্রা তেত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের প্রখর উত্তাপ। আমি একটা রিকশা নিয়ে বনানী থেকে শহরের কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি। রিকশা হচ্ছে পেশিশক্তির চালিত একটি যান। এদের সচল চিত্রশালাও বলা যায়। কারণ প্রতিটি রিকশার পেছনে বহুবর্ণ পেইন্টিং আছে। আমি যে রিকশায় চড়েছি, সেখানে একটি বাঘের ছবি আছে। বাঘের মাথার উপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাচ্ছে। তার সামনে আছে একটা ট্রেন।
আমার রিকশাওয়ালার নাম হামিদ। সে একজন হাসিখুশি যুবক। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সবাই হাসিখুশি। আন্তর্জাতিক একটি জরিপে বাংলাদেশ বিশ্বের সুখী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানে স্থান করে নিয়েছে।
আমি হামিদকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললাম, তুমি আজ আমার গাইড। তুমি আমাকে তোমাদের বর্ষবরণ উৎসব দেখাবে।
হামিদ ইংরেজিতে বলল, ইয়েস স্যার। তার ইংরেজি জ্ঞান ইয়েস এবং নো-তে সীমাবদ্ধ। এতে অবশ্যি আমাদের ভাবের আদান-প্রদানে অসুবিধা হলো না। সে আমার অদ্ভুত বাংলা বুঝতে পারছে।
হামিদ বলল, আপনি স্যার আসল জিনিস মিস দিলেন। সূর্য ওঠার আগে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। রমনা বটমূলে। কী সুন্দর গান যে হয়! গান শুনলে চোখে পানি আসে।
তুমি শুনেছ?
তিনবার শুনেছি। তিনবারই চোখের পানি ফেলেছি। প্রথমবার অনেক বেশি, পরের দুইবার কম।
এইবার গান শুনতে যাও নাই কেন?
পেটের ধান্ধায় যাই নাই। ট্রিপে না গেলে ঘরে উপাস থাকব। সংসারে অনেক খানেওয়ালা_ আমার মা, পরিবার আর দুই মাইয়া।
তারা কোথায়?
সক্কালবেলায় এরারে গান শুনতে নামায়া দিছি। দুপুরে একসাথে পান্তা খাব। এরা সইন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব তারপর ঘরে ফিরব।
পান্তা জিনিসটা কী?
পানি ভাত। নববর্ষে পান্তা ভাত ইলিশ মাছ ভাজা দিয়া খাইতে হয়। আমাদের নিয়ম।
নিয়ম?
জি স্যার, আমরা কঠিন নিয়মের মানুষ। নিয়মের বাইরে যাই না।
তোমাদের আর কী নিয়ম?
পোশাকে নিয়ম আছে। ফাল্গুন মাসের এক তারিখে মেয়েদের পরতে হয় হলুদ শাড়ি। আজ পরতে হয় লাল শাড়ি।
শাড়ি বিষয়ে বলি। শাড়ি বাংলাদেশের মেয়েদের প্রধান পোশাক। এটা ছয় গজ লম্বা এবং সোয়া গজ প্রস্থের একখণ্ড বর্ণিল বস্তু। মেয়েরা প্রথমে স্কার্ট এবং টপস পরে, তারপর শাড়ি দিয়ে স্কার্ট টপস ঢেকে দেয়। টপসকে এরা বলে ‘ব্লাউজ’ এবং স্কার্টকে বলে ‘শায়া’। কোনো বোতাম বা ফিতা ছাড়াই অদ্ভুত এক উপায়ে এ দেশের মেয়েরা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রাখে। আমাকে বলা হয়েছে শাড়ি গা থেকে খুলে পড়ার ঘটনা কখনোই ঘটে না।
হামিদ ঝড়ের গতিতে রিকশা চালাচ্ছে। আমি বললাম, এত তাড়া কিসের! আস্তে চালাও। একসিডেন্ট করবে।
হামিদ বলল, তাড়াতাড়ি না গেলে আরেকটা জিনিস মিসিং হবে।
কী জিনিস?
আর্ট কলেজের পুলাপান এই দিনে পাগলা মিছিল বাইর করে। তারা পাগলা তো, এই কারণে তারার মিছিলও পাগলা। না দেখলে জেবন বৃথা।
পাগলা মিছিল দেখলাম। মুখোশ মিছিল। উদ্দাম আনন্দের শোভাযাত্রা। ব্রাজিলের সাম্বা উৎসবের শোভাযাত্রার সঙ্গেই কেবল এই মিছিল তুলনীয়।
হামিদ মিয়া এক চটপটির দোকানের পাশে তার রিকশা জমা রেখে আমাকে নিয়ে রমনা উদ্যানে ঢুকল। উদ্যানে বৃক্ষের অরণ্যের ভেতর সুখী মানুষের অরণ্য। কত না তাদের আনন্দ! বাবার কাঁদে শিশু ভেঁপু বাজাচ্ছে। মা কাচের চুড়ি কিনছে (এই উৎসবে মেয়েদের কাচের চুড়ি কেনা নাকি বাধ্যতামূলক)।
রিকশাওয়ালা তার পরিবারকে খুঁজে বের করল। হতদরিদ্র এই পরিবারটিরও আনন্দের সীমা নেই। হামিদের দুই মেয়ে মাটির খেলনা কিনেছে। শিশুদের মাটির খেলনা কিনে দেওয়াও নববর্ষ অনুষ্ঠানের অঙ্গ।
হামিদ আমাকে পান্তা খেতে নিয়ে গেল। সে বলল, স্যারের পান্তার টেকা আমি দিমু। স্যার আইজ আমার মেহমান।
হামিদের পরিবারের সঙ্গে আমি মাটির হাঁড়িতে পান্তা খেতে বসলাম। হামিদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইলিশ মাছের একটা বড় টুকরা যেন আমি পাই।
আমি আমেরিকান। আমেরিকানরা আবেগশূন্য না। তবে আবেগে আমেরিকানদের চোখ কখনো ভিজে উঠে না। আমি লক্ষ্য করছি, আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠছে। যে দেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-বঞ্চনা একপাশে ফেলে আনন্দে মেতে উঠতে পারে, সে দেশের মানুষ অনেক দূর যাবে তা বলাই বাহুল্য। থ্রি চিয়ারস ফর দেম! হিম হিপ হুররে!!
বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) নববর্ষ পালনের সূচনা হয় কবি জাহানারা আরজুর বাসায়, ১৯৬৪ সালে। সেখানে তরুণ কবি হাসান হাফিজুর রহমান বৈশাখ নিয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারতের যুদ্ধের পর নববর্ষ উদযাপন বন্ধ হয়ে যায়।
রমনা বটমূলে প্রভাতের সূর্যোদয়ের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপনের শুরু করে ছায়ানট।
আরেকটি তথ্য, একমাত্র নেপাল ছাড়া বাংলা ক্যালেন্ডার সরকারিভাবে পৃথিবীর কোথাও ব্যবহার করা হয় না।
অতি অদ্ভুত এক মিল আমরা খুঁজে পাই পাঞ্জাবিদের বৈশাখী উৎসবের সঙ্গে। তারাও পহেলা বৈশাখ পালন করে নতুন বর্ষের প্রথম দিবস হিসেবে। বিস্তারিত আমার জানা নেই।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের জনগোষ্ঠীর নব্বই শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে দুর্নীতি সম্পর্কযুক্ত। দুর্নীতিতে শীর্ষ সূত্রে প্রায় প্রতিবারই এই দেশের নাম আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে (বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা) আছে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ। যেমন- জঙ্গি মৌলবাদ। এরা দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে প্রায়ই তারা বোমাবাজি করে। দেশটিতে আমেরিকার মতোই প্রধান দুটি দল। পরস্পরের প্রতি এদের আচরণ অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ। যে দল ক্ষমতায় থাকে না, তার প্রধান লক্ষ্য থাকে হরতাল দিয়ে দেশকে অচল করে দেওয়া। হরতাল মানেই দোকানপাট, গাড়ি ভাঙচুর।
গাড়ি ভাঙা এই দেশের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি তুচ্ছ কারণে এরা শত শত গাড়ি ভাংচুর করে। আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী কর্মীরা এ ধরনের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে কখনো হস্তক্ষেপ করেন না।
দেশটির আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। র্যাব নামের একটি সংস্থা এ দেশে আছে, তারা যে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। তার জন্য তাদের জবাবদিহিতার ভেতর দিয়ে যেতে হয় না। এসব হত্যাকাণ্ডের নাম ‘ক্রসফায়ার’। সঙ্গত কারণেই এদের পোশাক ফাঁসির জল্লাদদের পোশাক। তারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য কালো চমশা পরে এবং কালো রুমালে মাথা ঢেকে রাখে।
দেশ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দেওয়া হলো। এখন এই দেশের রাজধানী ঢাকা শহরের মানুষদের বর্ষবরণ উৎসব পালনের কথা বলব। শুরুতেই বলে নিচ্ছি এই দেশটিতে সরকারিভাবে কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয় না। এই ক্যালেন্ডারের ব্যবহার বিভিন্ন উৎসবের দিন নির্ধারণে। বাংলা ক্যালেন্ডারে নববর্ষ হলো বৈশাখের প্রথম দিন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এপ্রিলের ১৪ তারিখ।
দিনটি ছিল অসম্ভব গরম। তাপমাত্রা তেত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের প্রখর উত্তাপ। আমি একটা রিকশা নিয়ে বনানী থেকে শহরের কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি। রিকশা হচ্ছে পেশিশক্তির চালিত একটি যান। এদের সচল চিত্রশালাও বলা যায়। কারণ প্রতিটি রিকশার পেছনে বহুবর্ণ পেইন্টিং আছে। আমি যে রিকশায় চড়েছি, সেখানে একটি বাঘের ছবি আছে। বাঘের মাথার উপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাচ্ছে। তার সামনে আছে একটা ট্রেন।
আমার রিকশাওয়ালার নাম হামিদ। সে একজন হাসিখুশি যুবক। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সবাই হাসিখুশি। আন্তর্জাতিক একটি জরিপে বাংলাদেশ বিশ্বের সুখী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানে স্থান করে নিয়েছে।
আমি হামিদকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললাম, তুমি আজ আমার গাইড। তুমি আমাকে তোমাদের বর্ষবরণ উৎসব দেখাবে।
হামিদ ইংরেজিতে বলল, ইয়েস স্যার। তার ইংরেজি জ্ঞান ইয়েস এবং নো-তে সীমাবদ্ধ। এতে অবশ্যি আমাদের ভাবের আদান-প্রদানে অসুবিধা হলো না। সে আমার অদ্ভুত বাংলা বুঝতে পারছে।
হামিদ বলল, আপনি স্যার আসল জিনিস মিস দিলেন। সূর্য ওঠার আগে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। রমনা বটমূলে। কী সুন্দর গান যে হয়! গান শুনলে চোখে পানি আসে।
তুমি শুনেছ?
তিনবার শুনেছি। তিনবারই চোখের পানি ফেলেছি। প্রথমবার অনেক বেশি, পরের দুইবার কম।
এইবার গান শুনতে যাও নাই কেন?
পেটের ধান্ধায় যাই নাই। ট্রিপে না গেলে ঘরে উপাস থাকব। সংসারে অনেক খানেওয়ালা_ আমার মা, পরিবার আর দুই মাইয়া।
তারা কোথায়?
সক্কালবেলায় এরারে গান শুনতে নামায়া দিছি। দুপুরে একসাথে পান্তা খাব। এরা সইন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব তারপর ঘরে ফিরব।
পান্তা জিনিসটা কী?
পানি ভাত। নববর্ষে পান্তা ভাত ইলিশ মাছ ভাজা দিয়া খাইতে হয়। আমাদের নিয়ম।
নিয়ম?
জি স্যার, আমরা কঠিন নিয়মের মানুষ। নিয়মের বাইরে যাই না।
তোমাদের আর কী নিয়ম?
পোশাকে নিয়ম আছে। ফাল্গুন মাসের এক তারিখে মেয়েদের পরতে হয় হলুদ শাড়ি। আজ পরতে হয় লাল শাড়ি।
শাড়ি বিষয়ে বলি। শাড়ি বাংলাদেশের মেয়েদের প্রধান পোশাক। এটা ছয় গজ লম্বা এবং সোয়া গজ প্রস্থের একখণ্ড বর্ণিল বস্তু। মেয়েরা প্রথমে স্কার্ট এবং টপস পরে, তারপর শাড়ি দিয়ে স্কার্ট টপস ঢেকে দেয়। টপসকে এরা বলে ‘ব্লাউজ’ এবং স্কার্টকে বলে ‘শায়া’। কোনো বোতাম বা ফিতা ছাড়াই অদ্ভুত এক উপায়ে এ দেশের মেয়েরা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রাখে। আমাকে বলা হয়েছে শাড়ি গা থেকে খুলে পড়ার ঘটনা কখনোই ঘটে না।
হামিদ ঝড়ের গতিতে রিকশা চালাচ্ছে। আমি বললাম, এত তাড়া কিসের! আস্তে চালাও। একসিডেন্ট করবে।
হামিদ বলল, তাড়াতাড়ি না গেলে আরেকটা জিনিস মিসিং হবে।
কী জিনিস?
আর্ট কলেজের পুলাপান এই দিনে পাগলা মিছিল বাইর করে। তারা পাগলা তো, এই কারণে তারার মিছিলও পাগলা। না দেখলে জেবন বৃথা।
পাগলা মিছিল দেখলাম। মুখোশ মিছিল। উদ্দাম আনন্দের শোভাযাত্রা। ব্রাজিলের সাম্বা উৎসবের শোভাযাত্রার সঙ্গেই কেবল এই মিছিল তুলনীয়।
হামিদ মিয়া এক চটপটির দোকানের পাশে তার রিকশা জমা রেখে আমাকে নিয়ে রমনা উদ্যানে ঢুকল। উদ্যানে বৃক্ষের অরণ্যের ভেতর সুখী মানুষের অরণ্য। কত না তাদের আনন্দ! বাবার কাঁদে শিশু ভেঁপু বাজাচ্ছে। মা কাচের চুড়ি কিনছে (এই উৎসবে মেয়েদের কাচের চুড়ি কেনা নাকি বাধ্যতামূলক)।
রিকশাওয়ালা তার পরিবারকে খুঁজে বের করল। হতদরিদ্র এই পরিবারটিরও আনন্দের সীমা নেই। হামিদের দুই মেয়ে মাটির খেলনা কিনেছে। শিশুদের মাটির খেলনা কিনে দেওয়াও নববর্ষ অনুষ্ঠানের অঙ্গ।
হামিদ আমাকে পান্তা খেতে নিয়ে গেল। সে বলল, স্যারের পান্তার টেকা আমি দিমু। স্যার আইজ আমার মেহমান।
হামিদের পরিবারের সঙ্গে আমি মাটির হাঁড়িতে পান্তা খেতে বসলাম। হামিদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইলিশ মাছের একটা বড় টুকরা যেন আমি পাই।
আমি আমেরিকান। আমেরিকানরা আবেগশূন্য না। তবে আবেগে আমেরিকানদের চোখ কখনো ভিজে উঠে না। আমি লক্ষ্য করছি, আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠছে। যে দেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-বঞ্চনা একপাশে ফেলে আনন্দে মেতে উঠতে পারে, সে দেশের মানুষ অনেক দূর যাবে তা বলাই বাহুল্য। থ্রি চিয়ারস ফর দেম! হিম হিপ হুররে!!
পাদটিকা (কিছু তথ্য)
বঙ্গদেশে নববর্ষ উৎসব ছিল না। ছিল চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। মাইকেল মধুসূদনের বন্ধু হেডমাস্টার রাজনারায়ণ বসু তার স্কুলে নববর্ষ পালনের ব্যবস্থা করেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করেন শান্তিনিকেতনে।
বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) নববর্ষ পালনের সূচনা হয় কবি জাহানারা আরজুর বাসায়, ১৯৬৪ সালে। সেখানে তরুণ কবি হাসান হাফিজুর রহমান বৈশাখ নিয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারতের যুদ্ধের পর নববর্ষ উদযাপন বন্ধ হয়ে যায়।
রমনা বটমূলে প্রভাতের সূর্যোদয়ের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপনের শুরু করে ছায়ানট।
আরেকটি তথ্য, একমাত্র নেপাল ছাড়া বাংলা ক্যালেন্ডার সরকারিভাবে পৃথিবীর কোথাও ব্যবহার করা হয় না।
অতি অদ্ভুত এক মিল আমরা খুঁজে পাই পাঞ্জাবিদের বৈশাখী উৎসবের সঙ্গে। তারাও পহেলা বৈশাখ পালন করে নতুন বর্ষের প্রথম দিবস হিসেবে। বিস্তারিত আমার জানা নেই।
No comments:
Post a Comment