হুমায়ূন আহমেদ প্রয়াত হয়েছেন মাত্র দুই বছর, কিন্তু তাকে নিয়ে ভক্তদের সীমাহীন আগ্রহ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ফলে, মৃত্যুর পরেও হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আগ্রহ ও উদ্দীপনার শেষ নেই।
হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮, ১৯ জুলাই ২০১২) বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক গণ্য করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম জনপ্রিয় একটি চরিত্রের নাম শুভ্র। এই শুভ্র চশমা ছাড়া চোখে কিছুই দেখতে পায় না। চশমা হারিয়ে যাওয়ার কারণে তার জীবনে নানা জটিলতাও সৃষ্টি হয় শুভ্রকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন উপন্যাসে। হুমায়ূন আহমেদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার সৃষ্টি করা অন্যতম চরিত্র হিমু, মিসির আলী কিংবা শুভ্র হয়তো তার নিজেরই ছায়া। পাঠকমাত্রই জানেন, মিসির আলীও চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে জটিল সব রহস্যের সমাধান করতেন। তো, হুমায়ূন আহমেদ নিজেও কিন্তু চশমা ছাড়া চলতে পারতেন না।
এখন আগ্রহী পাঠকরা চাইলেই জাতীয় জাদুঘরের শোকেসে হুমায়ূন আহমেদের মোটা ফ্রেমের চশমাগুলো দেখে আসতে পারেন। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিকের ব্যবহূত জিনিসপত্র নিয়ে জাদুঘরে করা হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ কর্নার।
১৩ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৬৬তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিককে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ ও উদ্দীপনার কোনো শেষ নেই। ফলে, হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের পক্ষ থেকে তার এবারের জন্মবার্ষিকী দেশবাসীর সঙ্গে উদ্যাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রয়াত এ কথাসাহিত্যিকের ৬৬তম জন্মবার্ষিকীকে সামনে রেখে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন জাতীয় জাদুঘরে হুমায়ূন আহমেদ কর্নার করার জন্য মহাপরিচালককে অনুরোধ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১২ নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে জাতীয় জাদুঘরের বিশেষ আয়োজন 'হুমায়ূন পক্ষ'।
এ আয়োজনে থাকছে হুমায়ূন আহমেদের লেখা বই, ব্যক্তিগত ডায়েরি, চিঠিপত্র, সাহিত্যের পান্ডুলিপি, অঙ্কিত চিত্রকর্ম, নাটক এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। এ আয়োজন সামনে রেখে লেখকের ভাই অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল হুমায়ূন আহমেদের অাঁকা ২০টি চিত্রকর্ম, একটি ছবির রিপ্রডাকশন, ব্যক্তিগত চিঠি, দিনলিপি (ডায়েরি) জাদুঘরের মহাপরিচালক ফযজুল লতিফ চৌধুরীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন। হস্তান্তর অনুষ্ঠানে জাদুঘরের প্রতিনিধি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবালের পত্নী ইয়াসমিন হক ও হুমায়ূন-পুত্র নুহাশ আহমেদ।
এ আয়োজনে জাতীয় জাদুঘরে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে শুরু করে তার হাতে লেখা পান্ডুলিপি এবং বেশকিছু চিত্রকর্ম দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে।
হুমায়ূন আহমেদ কম্পিউটারে লিখতেন না। তার যাবতীয় সাহিত্যকর্মই দামি কলমে অফসেট পেপারে রচিত হতো। স্পষ্ট এবং গোটা গোটা অক্ষরে লিখতেন তিনি, প্রতিটি পৃষ্ঠায়ই লেখা ছাড়াও প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই ফাঁকা জায়গা রাখতে ভালোবাসতেন তিনি। লেখক হিসেবে নিজের পছন্দের পরিবেশ ছাড়া লিখতে পারতেন না তিনি। মাটিতে আসন গেড়ে বসে পিঁড়ির মতো একটি উঁচু টেবিল ব্যবহার করতেন তিনি লেখার জন্য। হুমায়ূন আহমেদের হাতে লেখা অনেক পান্ডুলিপিই স্থান পেয়েছে জাদুঘরের এ প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীটি দেখলে লেখক হিসেবে এক বিলাসী হুমায়ূন আহমেদকে আবিষ্কার করবেন পাঠক।
'মৃত্যুতে খুব বেশি দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিটি জীবিত প্রাণীকেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর মরতে হবে। তবে এ মৃতু্যু মানে পুরোপুরি ধ্বংস নয়। মানুষের শরীরে অযুত, কোটি, নিযুত ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেলস যেমন, ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন- এদের কোনো বিনাশ নেই। এরা থেকেই যাবে। ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে। কাজেই মানুষের মৃত্যুতে খুব বেশি কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।' (নি, হুমায়ূন আহমেদ)।
নিজের মৃত্যু নিয়ে বেশ চিন্তা করতেন হুমায়ূন আহমেদ, তার লেখাপত্রেও এর নিদর্শন পাওয়া যায়। এমনকি আর্কিটেক্ট ডেকে কবরের ডিজাইন করিয়ে নিজের বেডরুমে বাঁধাই করে ঝুলিয়ে রাখতেন তিনি। ফলে, মৃত্যুর পরও ভক্তদের যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করে রাখতে পেরেছেন তিনি।
চিত্রকলার প্রতি আগ্রহের কারণে শিল্পী ধ্রুব এষের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। শিল্পী ধ্রুব এষ যত্নের সঙ্গে চিত্রকলার হাতেখড়ি করাতে পেরেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের। ফলে, শেষ বয়সে হুমায়ূন আহমেদের পেইন্টিংয়ের প্রতি বেশ ঝোঁক দেখা যায়।
হুমায়ূন আহমেদের আঁকা চিত্রকর্ম |
জাদুঘরের হুমায়ূন আহমেদ কর্নারে তার অাঁকা বেশ কিছু চিত্রকর্মেরও সন্ধান পাবেন ভক্তেরা। যার মধ্য বেশ কিছু স্কেচ, ওয়াটার কালার, ওয়েল পেইন্টিং এবং পোর্ট্রেট রয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সফল টিভি নির্মাতা ও চলচ্চিত্রকার। তার লেখা স্ক্রিপ্ট থেকে তিনি বানিয়েছেন বেশ কয়েকটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সে চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটির স্ক্রিপ্টও স্থান পেয়েছে এ প্রদর্শনীটিতে।
মেহের আফরোজ শাওন বলেন, পারিবারিকভাবে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন বহুবার পালিত হয়েছে। জাদুঘরের এ আয়োজন অনুষ্ঠানমালায় ভিন্নমাত্রা যোগ করছে। মেহের আফরোজ শাওন জাতীয় জাদুঘরে হুমায়ূন আহমেদ কর্নার করার জন্য মহাপরিচালককে অনুরোধ করেন। শাওন ১১৮টি এবং মাযহারুল ইসলাম ১৫টি স্মৃতি স্মারক জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালকের কাছে হস্তান্তর করেন।
শাওন বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত এ জিনিসপত্রগুলো দিয়ে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, যেন আমি আমার হূদয়ের একটি অংশ দিয়ে দিলাম।'
'হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি জিনিস, তার চশমা, হাতঘড়ি, সেলফোন_ এ সবকিছু নিয়েই আমার হাজারও স্মৃতি', বলেন শাওন। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ভক্তদের যে আগ্রহ, তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এ উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান শাওন।
ব্যক্তি জীবনে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বেশ আকর্ষণীয় চরিত্র। তার জীবনের নানা মুহূর্ত উঠে এসেছে বিভিন্ন আলোকচিত্রে। নুহাশপল্লীতে দিঘির পাড়ে তিনি বসে আছেন, কিংবা শীতের সকালে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে ছাদে বসে আছেন_ এমনসব আলোকচিত্রও স্থান পেয়েছে এ প্রদর্শনীতে। স্ত্রীকে নিয়ে একই ক্যানভাসে ছবি অাঁকছেন, কিংবা বেডরুমে স্ত্রী-পুত্রের ছবি তুলছেন, এমন ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবিগুলোও বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করবে ভক্তদের মাঝে।
এছাড়াও প্রদর্শনীর এক অংশে স্থান পেয়েছে হুমায়ূন আহমেদের লেখা বইগুলোর একাংশ। মোটকথা, হুমায়ূন আহমেদের জন্মবার্ষিকী নিয়ে জাতীয় জাদুঘরের এ উদ্যোগ সত্যিকার অর্থেই ভক্ত-পাঠকদের জন্য একটি বিশেষ আয়োজন।
[লেখকঃ শোয়েব সর্বনাম]
No comments:
Post a Comment