ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু (তৃতীয় পর্ব) হিমুর পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ - হুমায়ূন আহমেদ

কলকাতা থেকে 'দেশ' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হয়। একটা পত্রিকা কতদূর ক্ষমতাধর তা 'দেশ' পত্রিকা না দেখলে আমি জানতাম না। বলা হয়ে থাকে যেকোনো অগা মগা বগা লেখককে এই পত্রিকা আসমানে তুলে দিতে পারে। মহান লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আবার সত্যিকারের মহান কোনো লেখককেও ধরাশায়ী করতে পারে।
এই পত্রিকায় কারও লেখা ছাপা হওয়ার মানে (বিশেষ করে শারদীয় সংখ্যায়) লেখক হিসেবে কপালে স্থায়ী সিল পড়ে যাওয়া। এই সিলের কালি অলেপনীয় ধুলেও যাবে না। কপালে জলজল করতে থাকবে। এক সকালে 'দেশ' পত্রিকার এক প্রতিনিধি আমার বাসায় উপস্থিত। তার সঙ্গে নানা গল্প হচ্ছে। গল্প তিনি করছেন আমি শুনছি। আমি ক্লাসে যাব, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ভদ্রতার খাতিরে বলতেও পারছি না। হাজার হলেও বিদেশি মেহমান। এক পর্যায়ে ভদ্রলোক বললেন, আমরা আপনার একটা উপন্যাস শারদীয় সংখ্যায় ছাপাব। তবে দেশে ছাপাব নাকি আনন্দবাজারে ছাপাব, নাকি সানন্দায় ছাপাব তা বলতে পারছি না। সাগরময়দা ঠিক করবেন। ভদ্রলোক হয়তো ধারণা করেছিলেন তার কথা শুনে আনন্দে আমি এমন লাফ দেব যে সিলিংয়ে মাথা ঠেকে যাবে।

             আমি তা না করে শুকনো গলায় বললাম, হুঁ। ভেবে দেখি।
            -কী ভাববেন? পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কত বড় সুযোগ। 
             আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, ভাই আমি সুযোগ সন্ধানী মানুষ না। আমি লেখক। লেখক কখনো সুযোগের সন্ধান করে না। সুযোগ লেখকদের সন্ধান করে। 
            -তার মানে আপনি লিখবেন না?
             আমি বললাম, শুধুমাত্র 'দেশ' পত্রিকা যদি তার শারদীয় সংখ্যায় লেখা ছাপে তাহলেই পাণ্ডুলিপি পাঠাব। দেশ পত্রিকা ছাড়া না।
            ভদ্রলোক মোটামুটি হতভম্ব অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, যাই। নমস্কার।

আমি ধরেই নিয়েছিলাম এই বিষয়ে আর কিছু শুনব না। আশ্চর্যের ব্যাপার, পনেরো দিনের মাথায় দেশ পত্রিকার সম্পাদক চিঠি দিয়ে জানালেন তারা আমার একটি উপন্যাস শারদীয় দেশ পত্রিকায় ছাপাতে চান। হিমুকে নিয়ে লেখা একটা উপস্যাস পাঠালাম। ছাপা হলো। পরের বছর আবার চিঠি এবারও তারা একটি উপন্যাস ছাপাবেন। পাঠালাম আরেকটা হিমু।

পর পর ছয় বছর কিংবা সাত বছর আমি শারদীয় দেশ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছি। বেশির ভাগই হিমুবিষয়ক রচনা। পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা আমার সাহিত্য প্রতিভা (?) সম্পর্কে কোনো ধারণা পেয়েছেন কি না জানি না। হিমু বিষয়ে ভালোই ধারণা পেয়েছেন| তার প্রমাণও পেলাম।

                         কলকাতায় গিয়েছি কোনো এক বইমেলায়। সে দেশে চেহারা দেখে আমাকে কেউ চিনবে না, কাজেই লেখকসুলভ নকল গাম্ভীর্য নিয়ে হাঁটাহাঁটি করার প্রয়োজন নেই। আমি মনের সুখে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাত্ আমাকে চমকে দিয়ে একজন আমার পা ছুয়ে বলল, দাদা আমি হিমু!

             আমি অবাক হয়ে তাকিযে ধুতি পরা হিমু দেখছি। পাঞ্জাবি হলুদ রঙের। পায়ে জুতা নেই-খালি পা। লক্ষণ বিচারে হিমু তো বটেই।
            -আপনি কত দিন ধরে হিমু?
            -দুই বছরের উপর হয়েছে দাদা।

            আমি বললাম, পাঞ্জাবির কি পকেট আছে?
            -পকেট নেই|
            -টাকা-পয়সা রাখেন কোথায়?
ভদ্রলোক পাঞ্জাবি উঠিয়ে দেখালেন, কেমারের কালো ঘুনসির সঙ্গে কাপড়ের ব্যাগ লাগানো-টাকা-পয়সা সেখানেই থাকে।
            -দাদা! আমি দুজনের ভক্ত। আপনার এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের। আপনাদের দুজনের ছবি ঠাকুরঘরে আছে।

আমি চমৎকৃত! সাত বছর 'দেশ' পত্রিকায় লেখালেখির কারণে যদি কারও ঠাকুরঘরে ঢুকে যেতে পারি সেটা কম কী? গলায় সুর থাকলে গাইতাম অকত অধম জেনেও তো তুমি কম করে কিছু দাওনি।

বিদেশে বেশ কিছু হিমুর দেখা পেয়েছি। বিদেশের হিমুরা কঠিন প্রকতির। একশ পার্সেন্ট খাঁটি ভেজালবিহীন হিমু। জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের হিমুর কথা বলি। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। বরফ পড়বে পড়বে করছে, এখনো পড়া শুরু করেনি। এই ঠাণ্ডায় খালি পায়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে একজন উপস্থিত। গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বলল, স্যার আমি হিমু।
             -কতদিন ধরে?
             -তিন বছরের বেশি হয়েছে| দেশেও হিমু ছিলাম। ছেলেটা এমনভাবে কথা বলছে যে হিমু একটা ধর্ম। সে ধর্ম পালন করছে। এর বেশি কিছু না। আমি হিমু ধর্ম প্রচারক।

গত বইমেলায় এক কাণ্ড ঘটল। মধ্যবয়স্ক একজন ভিড় ঠেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, স্যার, আমি ঠিক করেছি মার্চেও তিন তারিখ থেকে হিমু হব। হিমু হওয়ার নিয়মকানুন কী?
             আমি বললাম, মার্চের তিন তারিখ থেকে কেন? আমার জন্মদিন মার্চের তিন। এখন স্যার নিয়মকানুন বলেন।
             আমি নিয়মকানুন কী বলব? ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছি। কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আমাকে উদ্ধারের জন্য অন্যপ্রকাশের কমল এগিয়ে এল। সে গম্ভীর গলায় বলল, নিয়মকানুন সব বইয়ে দেওয়া আছে। বই পড়ে জেনে নিন। হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হাঁটবেন। এইটাই প্রাথমিক বিষয়।

            -প্রতি পূর্ণিমায় জোছনা দেখতে জঙ্গলে যেতে হবে?
            -গেলে ভালো হয়, তবে দু-একটা মিস হলেও ক্ষতি হবে না।

No comments:

ফেসবুক প্লাগইন তৈরি করেছেন শূন্য পেজ অ্যাডমিন হুমায়ূন আহমেদ

Post a Comment