ফাউন্টেনপেন (৪র্থ‌ পর্ব) পড়াশোনা - হুমায়ূন আহমেদ

বাংলা শব্দের মজার দ্বৈততা বিষয়ে আগেও লিখেছি। এখন আরেকবার, পড়ার সঙ্গে শোনা। যেন শোনাও পড়ারই অংশ।
আমরা যেভাবে পড়ি সেভাবে কি শুনি? সবাই চায় অন্যকে শোনাতে। নিজে শুনতে চায় না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমি নিজে। 'বৃদ্ধ বোকা সংঘের' আসরে যে কথা বলে তার কথা শুনতেই বিরক্তি লাগে। শুধু আমি মনের আনন্দে কথা বলে যাই। তখন আমার বিরক্তি লাগে না।
একটা বয়স পার হলে মানুষ 'কথা বলা রোগ'-এ আক্রান্ত হয়। এই বয়সটা একেকজনের জন্যে একেক রকম। সাধারণভাবে ষাট। কারণ এই বয়সেই মানুষের কর্মহীন সময়ের শুরু হয়। ষাট থেকে সত্তর এই দশ বছর সব মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নাকি এই দশ বছর অর্থপূর্ণ কথা বলে। তার পর থেকেই কথা থেকে সারবস্তু চলে যায়। বাহাত্তরে পা দিলে তো কথাই নেই।
প্রাচীন ভারতে বিদ্যাদানের কাজটা গুরুরা করতেন এই দশ বছর। পুরো বিদ্যাদানের প্রক্রিয়া ছিল কথানির্ভর। গুরু কথা বলতেন, শিষ্য শুনত। বিদ্যাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘসময় লাগত। একসময় গুরু বলতেন, আমার বিদ্যা যা ছিল সব শেখানো হয়েছে। এখন যাও, স্নান করে এসো। শিষ্য স্নান করে ফিরত। এই স্নান থেকেই এসেছে 'স্নাতক' শব্দ। শিষ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।
পাঠক আবার ভেবে বসবেন না যে শিষ্য দীর্ঘ পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালীন স্নান করেনি। অবশ্যই স্নান করেছে, তবে শেষ দিনের স্নান হলো স্নাতক হওয়ার স্নান।

আমাদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো শোনানির্ভর। বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া ছাত্রদের শুধু শুনে যেতে হয়।
ধর্মপ্রচারকরাও শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিষ্যরা গুরুর কথা শুনত। নবীজি (সা.)-কে আল্লাহর বাণী শোনানো হলো কথায়_'পড়ো! তোমার প্রভুর নামে...'
তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? শোনাটা পড়ার চেয়ে জরুরি? আগে শোনা তারপর পড়া। অর্থাৎ পড়াশোনা না, শোনাপড়া।
আমার আত্দীয়স্বজনরা মাঝেমধ্যে বেশ আয়োজন করে আমার কথা শুনতে আসেন। তাঁদের ধারণা, আমার কাছ থেকে শোনা কথাগুলো নাকি 'অতি উত্তম'। তাঁদের কথা শোনানো কঠিন কর্মের মধ্যে পড়ে, কারণ তাঁরা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসেন যে 'অতি উত্তম' কথা শুনবেন। মানসিক প্রস্তুতি থাকা মানেই আশাভঙ্গের সম্ভাবনা।
লেখকরা গুছিয়ে কথা বলবেন_এটা নিপাতনে সিদ্ধের মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ লেখক কথা বলতেই পছন্দ করেন না। তাঁরা আবার কথা শুনতেও পছন্দ করেন না। আমার অতি প্রিয় লেখক এডগার এলেন পো কারো সঙ্গেই কথা বলতেন না। কেউ কথা বলতে এলেও মহাবিরক্ত হতেন।
উল্টোদিকে আছেন চার্লস ডিকেন্স। শুধু তাঁর মুখের গল্প শোনার জন্যে টিকিট কেটে মানুষ হল ভর্তি করে ফেলত।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গ্র্যান্ডমাস্টার আইজাক এসিমভকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট লেকচার দেওয়ার জন্যে নিয়ে যেত। তিনি বক্তৃতার জন্যে প্রচুর টাকা নিতেন। এক ঘণ্টা কথা বলতেন, এই এক ঘণ্টা দর্শক মুগ্ধ হয়ে থাকত।
আচ্ছা আমি কি গল্প সুন্দর করে বলতে পারি? মনে হয় পারি। কেন বিনয়ের ধারেকাছে না গিয়ে পারি বলে ফেললাম, সেটা ব্যাখ্যা করি। হঠাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণামূলক রচনা পড়তে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন_
'হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করে সেগুলি রেকর্ড করে রাখা উচিত।...'
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লেখা পড়েই মনে হয় 'অন্যদিন' পত্রিকার সম্পাদক মাজহার উৎসাহিত হলো (সে অতি দ্রুত উৎসাহী হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে)। একদিন আড্ডায় গল্প করছি, হঠাৎ দেখি আমার বাঁ পাশে কালো মতো ছোট্ট একটা কী। সেখান থেকে জোনাকিপোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। আমি বললাম, এটা কী?
মাজহার বলল, স্যার, ভয়েস রেকর্ডার।
ভয়েস রেকর্ডার কেন?
এখন থেকে ঠিক করেছি আমাদের আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাত দিন আড্ডায় আসবে না।

শুরু করেছিলাম পড়াশোনা নিয়ে। চলে এসেছি আড্ডার গল্পে এবং নিজেকে বিরাট কথক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। পাঠক, স্যরি। তবে ফাউনটেনপেন যেহেতু আত্দজৈবনিক লেখা, নিজের কথা বলা যেতে পারে। যদিও নিজের প্রশংসা নিজেই করার মতো তুচ্ছ কিছু হতে পারে না। অন্যের নিন্দা করা যত দোষ নিজের প্রশংসা করা তার চেয়েও দোষ। কেউ যখন নিজের প্রশংসা নিজেই শুরু করেন তখন আমার গা চিড়বিড় করতে থাকে।
নিজের প্রশংসা নিজে করার সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ ইমদাদুল হক মিলন। গত বইমেলা বিষয়ে তার একটা লেখা কালের কণ্ঠের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছে। সে লিখেছে...
তখন আমার একটা বই বাংলা একাডেমী বেস্ট সেলার ঘোষণা করেছে। পাঠক-পাঠিকা বইটির জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রকাশক চাহিদামতো বই জোগান দিতে পারছে না। বইটির জন্যে বইমেলার অনেক জায়গায় কাটাকাটি মারামারি হচ্ছে...

যখন লেখালেখি করি না, আড্ডা দিতে বসি না, তখন কী করে সময় কাটাই? এই প্রশ্ন কিছুদিন আগে টেলিফোনে এক সাংবাদিক করলেন। আমি বললাম, তখন আমি একটা কাঁচি নিয়ে বসি। কাঁচি দিয়ে কেটেই সময় কাটাই।
সাংবাদিক আমার কথায় আহত হয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন। তাঁর জানার জন্যে এবং পাঠকদের জানার জন্যে বলি_তখন আমি সিনেমা দেখি এবং পড়ি। আমার কাছে মোটা একটা বই আছে। বইয়ের নাম 'ঙহব ঃযড়ঁংধহফ ড়হব ভরষস ঃযধঃ ুড়ঁ সঁংঃ ংবব নবভড়ৎব ুড়ঁ ফরব.' [এক হাজার একটি ছবি যা মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখতেই হবে।] বই দেখে দেখে ভিডিওর দোকান থেকে ফিল্ম আনি। ছবি দেখার পর বই থেকে নামটা কেটে দিই।
বইয়ে নাম নেই এমন ছবিও দেখা হয়। যেমন, সম্প্রতি দেখেছি আধঃবৎ, ঞরসব ঃৎধাবষষবৎ'ং রিভব.

বলতে ভুলে গেছি, আমি নিজে এক হাজার একটি বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করছি। যে বইগুলো মৃত্যুর আগে অবশ্যই পড়া উচিত। একটি বই পড়তে তিন দিন লাগলে ১০০১টি বই পড়তে লাগবে মাত্র দশ বছর।
পৃথিবীর সব লেখকের দোষগুলো আমার মধ্যে আছে। একটা গুণও আছে। আমিও লেখকদের মতো প্রচুর বই পড়ি। একসময় গল্প-উপন্যাস পড়তাম। এখন জানি না কেন গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে না। বই সবচেয়ে বেশি পড়ি যখন দেশের বাইরে যাই।
বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে আমার দুটি স্যুটকেস গোছানো হয়। একটায় থাকে কাপড়চোপড়। এটা শাওন গোছায়। আরেকটায় থাকে 'জবধফরহম গধঃবৎরধষ' বাংলায় 'পাঠবস্তু'। দুই মাস আগে মিসরের পিরামিড দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাওয়া বাতিল হয়েছে। 'জবধফরহম গধঃবৎরধষ'-এর স্যুটকেস গোছানোই আছে।
সেখানে কী কী বই নেওয়া হয়েছে তার তালিকা দিচ্ছি_
১. একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশন। আগরতলা বইমেলা থেকে একগাদা সায়েন্স ফিকশন কিনেছিলাম। একটাও পড়া হয়নি। যখনই বাইরে যাই একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশনের বই নিয়ে যাই। কেন জানি কখনো পড়া হয় না।
অসনধংংধফড়ৎ ডরঃযড়ঁঃ ঈৎবফবহঃরধষং
ঝবৎমবর ঝহবমড়া (জধফঁমধ চঁনষরংযবৎং)

২. ঞযব ঞৎধাবষং ড়ভ গধৎপড়ঢ়ড়ষড়
এ বইটি আমি আগে একবার পড়েছি। আবারও সঙ্গে নিচ্ছি কারণ মার্কোপোলোর গাঁজাখুরি ভ্রমণকাহিনী পড়তে ভালো লাগে।
সচেতন পাঠক নিশ্চয় ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। মার্কোপোলোর ভ্রমণকাহিনীকে আমি গাঁজাখুরি বলছি। কারণ ব্যাখ্যা করি। তিনি ভারতবর্ষে (বর্ণনা শুনে মনে হয় বাংলাদেশ) এক দল মানুষ দেখেছেন, যাদের মুখ কুকুরের মতো। এরা কুকুরের মতোই ডাকে।
এই বাংলাদেশেই আরেক দল মানুষ দেখেছেন যারা প্রকাশ্যে যৌনসঙ্গম করে। এতে কোনো লজ্জা বোধ করে না।
তিনি চীন ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু গ্রেট চায়নিজ ওয়াল তাঁর চোখে পড়েনি।

৩. ঞযব ঊহফ ড়ভ ঃরসব
এটি বিজ্ঞানের বই। 'সময়' কী তা ব্যাখ্যা করা। সহজপাঠ্য।

৪. ঞযব উবসড়হ ঐধহঁহঃবফ ডড়ৎষফ
ঈধৎষ ঝধমধহ.
কার্ল সেগান আমার অতি পছন্দের লেখকদের একজন। তাঁর লেখা ঈড়ংসড়ং বইটির আমি একসঙ্গে দুটি কপি কিনেছিলাম যাতে একটি হারিয়ে গেলে অন্যটি থাকে। হায় খোদা, দুটিই হারিয়েছে!

৫. বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বাবুরনামা। এই বইটিও আগে ইংরেজিতে পড়া। আবারও পড়ছি, কারণ একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার বাসনা আছে। সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে উপন্যাস। নাম দেব 'বাদশাহ নামদার'। হুমায়ুন প্রসঙ্গে যেখানে যা পাচ্ছি পড়ে ফেলছি।
কী আশ্চর্য! একের পর এক বইয়ের নাম লিখে যাচ্ছি কেন? আমি স্যুটকেসে কী সব বই ভরেছি তা পাঠকদের জানানোর প্রয়োজন কি আছে?
আছে। কী ধরনের বই আমি পড়তে পছন্দ করি, কেন করি_তা জানানো।
আমি নানা ধর্মগ্রন্থ ঘেঁটেছি একটা বিষয় জানার জন্যে_বেহেশত বা স্বর্গে কি কোনো লাইব্রেরি থাকবে? সুখাদ্যের বর্ণনা আছে, অপূর্ব দালানের কথা আছে, উৎকৃষ্ট মদ্যের কথা আছে, রূপবতী তরুণীর কথা আছে, বহুমূল্য পোশাকের কথা আছে, সংগীতের কথা আছে। লাইব্রেরির কথা নেই।

লাইব্রেরি হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের ফসল। বেহেশতে হয়তো মানুষের চিন্তা ও জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সেখানকার চিন্তা অন্য, জ্ঞান অন্য। বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ জ্ঞান।
অবশ্যপাঠ্য বইয়ের প্রথম তালিকা।
লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখা-
১. পথের পাঁচালী
২. দৃষ্টি প্রদীপ
৩. আরণ্যক
৪. ইছামতী
৫. দেবযান

পাদটীকা
ইড়ড়শং ধৎব ধ ফবষরমযঃভঁষ ংড়পরবঃু. ওভ ুড়ঁ মড় রহঃড় ধ ৎড়ড়স ভরষষবফ রিঃয নড়ড়শং, বাবহ রিঃযড়ঁঃ ঃধশরহম ঃযবস ফড়হি ভৎড়স ঃযবরৎ ংযবষাবং, ঃযবু ংববস ঃড় ংঢ়বধশ ঃড় ুড়ঁ, ঃড় বিষপড়সব ুড়ঁ.
_ডরষষরধস ঊ. ষেধফংঃড়হব

No comments:

ফেসবুক প্লাগইন তৈরি করেছেন শূন্য পেজ অ্যাডমিন হুমায়ূন আহমেদ

Post a Comment