(বাংলা ভাষার অতি বিচিত্র বিষয় হলো শব্দের দ্বৈততা-গল্পগুজব, ফলমূল, হাসিঠাট্টা, খেলাধুলা। ধর্ম শব্দটি বেশিরভাগ সময়ই কর্মের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। সম্ভবত কর্মকে আমরা ধর্মের সমার্থক ভাবি।)
আমি এসেছি অতি কঠিন গোঁড়া মুসলিম পরিবেশ থেকে। আমার দাদা মাওলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁর বাবা জাহাঙ্গির মুনশি ছিলেন পীর মানুষ। আমার দাদার বাড়ি 'মৌলবিবাড়ি' নামে এখনো পরিচিত।
ছোটবেলায় দেখেছি দাদার বাড়ির মূল অংশে বড় বড় পর্দা ঝুলছে। পর্দার আড়ালে থাকতেন মহিলারা। তাদের কণ্ঠস্বর পুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ ছিল বিধায় তারা ফিসফিস করে কথা বলতেন। হাতে চুড়ি পরতেন না। চুড়ির রিনঝিন শব্দও পরপুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ। দাদাজান বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন হাততালির মাধ্যমে। এক হাততালির অর্থ-পানি খাবেন। দুই হাততালি-পান তামাক ইত্যাদি।
একবার বড় ঈদ উপলক্ষে দাদার বাড়িতে গিয়েছি। আমার বয়স ছয় কিংবা সাত। দাদাজান ডেকে পাঠালেন। বললেন, কলেমা তৈয়ব পড়।
আমি বললাম, জানি না তো।
দাদাজানের মুখ গম্ভীর হলো। দাদিজান আবার তাৎক্ষণিক শাস্তির পক্ষে। তিনি বললেন, পুলারে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, কলেমা জানে না।
দাদাজান বিরক্তমুখে বললেন, সে ছোট মানুষ। শাস্তি তার প্রাপ্য না। শাস্তি তার বাবা-মা'র প্রাপ্য।
বাবা-মা'র শাস্তি হয়েছিল কি না আমি জানি না। দাদা-দাদির কাছ থেকে মুক্তি পাচ্ছি এতেই আমি খুশি। ছুটে বের হতে যাচ্ছি, দাদাজান আটকালেন। কঠিন এক নির্দেশ জারি করলেন। এই নির্দেশে আমি সব জায়গায় যেতে পারব, একটা বিশেষ বাড়িতে যেতে পারব না। এই বিশেষ বাড়িটা দাদার বাড়ি থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজের মতো দূরে। গাছপালায় ঢাকা সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনে টলটলা পানির দিঘি। আমি অবাক হয়ে বললাম, ওই বাড়িতে কেন যাব না?
দাদিজান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পুলা বেশি কথা কয়। এরে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, মুখে মুখে কথা।
দাদাজান শাস্তির দিকে গেলেন না। শীতল গলায় বললেন, ওই বাড়িতে ধর্মের নামে বেদাত হয়। ওই বাড়ি মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ। দিনের বেলা যাওয়া যাবে। সন্ধ্যার পর না।
আমি ছোটচাচাকে ধরলাম যেন ওই বাড়িতে যেতে পারি। ছোটচাচা বললেন নিয়ে যাবেন। ওই বাড়ির বিষয়ে ছোটচাচার কাছ থেকে যা জানলাম তা হলো_ওই বাড়ি মুসলমান বাড়ি। তবে তারা অন্যরকম মুসলমান। সন্ধ্যার পর পুরুষ মানুষরা নাচে।
ঘটনা কী জানার জন্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। সারাটা দিন ছটফটানির ভেতর দিয়ে গেল। সন্ধ্যা মিলাবার পর ছোটচাচার সঙ্গে ওই বাড়ির বৈঠকখানায় উপস্থিত হলাম। বাড়ির প্রধান শান্ত সৌম্য চেহারার এক বৃদ্ধ আমাকে কোলে নিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ফয়জুরের ছেলে আসছে। ফয়জুরের বড় পুলা আসছে। এরে কিছু খাইতে দাও।
সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় সত্যি সত্যি পুরুষদের নাচ শুরু হলো। ঘুরে ঘুরে নাচ। নাচের সঙ্গে সবাই মিলে একসঙ্গে বলছে 'আল্লাহু আল্লাহু' কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ভেতর মত্ততা দেখা দিল। একজন অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামাল না। সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চক্রাকারে ঘুরে নাচতেই থাকল। ছোটচাচা গলা নামিয়ে আমাকে কানে কানে বললেন, একটা মাত্র পড়েছে। আরও পড়ব। ধুপধাপ কইরা পড়ব। দেখ মজা।
ছোটচাচার কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুপ করে আরো একজন পড়ে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন কিছুই বুঝিনি, এখন মনে হচ্ছে_এরা কি কোনোভাবে সুফিবাদের সঙ্গে যুক্ত? ড্যান্সিং দরবেশ? এদের পোশাক সে রকম না, লুঙ্গি-গামছা পরা মানুষ। কিন্তু নৃত্যের ভঙ্গি এবং জিগির তো একই রকম। ড্যান্সিং দরবেশদের মধ্যে একসময় আবেশ তৈরি হয়। তারাও মূর্ছিত হয়ে পড়ে যান। এখানেও তো তাই হচ্ছে।
সমস্যা হলো বাংলাদেশের অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুফিবাদ আসবেইবা কীভাবে? কে এনেছে? কেন এনেছে? যখন কলেজে পড়ি (১৯৬৬) তখন কিছু খোঁজখবর বের করার চেষ্টা করেছি। এই বিশেষ ধরনের আরাধনা কে প্রথম শুরু করেন? এইসব। উত্তর পাইনি। তাদের একজনের সঙ্গে কথাবার্তার নমুনা দিচ্ছি।
প্রশ্ন: নাচতে নাচতে আপনি দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তখন কী হয়?
উত্তর: ভাবে চইলা যাই।
প্রশ্ন: কী রকম ভাব?
উত্তর: অন্য দুনিয়ার ভাব।
প্রশ্ন: পরিষ্কার করে বলুন।
উত্তর: বলতে পারব না। ভাবের বিষয়।
প্রশ্ন: চোখের সামনে কিছু দেখেন?
উত্তর: ভাব দেখি। উনারে দেখি।
প্রশ্ন: উনারে দেখেন মানে কী? উনি কে?
উত্তর: উনি ভাব।
সুফিবাদের উৎস হিসেবে ধরা হয় নবীজি (দ.)-এর সঙ্গে জিব্রাইল আলায়েস সালামের সরাসরি সাক্ষাতের হাদিস থেকে। একদিন নবীজি (দ.) বসে ছিলেন। মানুষের রূপ ধরে জিব্রাইল আলায়েস সালাম তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বললেন। একটি হলো-নিবেদন (Submission, ইসলাম), আরেকটি হলো বিশ্বাস (Faith, ঈমান), আর তৃতীয়টি হলো সুন্দর কর্মসাধন (Doing the beautiful, Bnmvb)।
প্রথম দুটি ইসলাম এবং ঈমান, ধর্মের পাঁচস্তম্ভের মধ্যে আছে। তৃতীয়টি নেই। এই তৃতীয়টি থেকেই সুফিবাদের শুরু।
সুফিবাদ বিষয়ে আমার জ্ঞান শুধু যে ভাসাভাসা তা নয়, ভাসাভাসার চেয়েও ভাসাভাসা। দোষ আমার না। দোষ সুফিবাদের দুর্বোধ্যতা এবং জটিলতার। সুফি সাধকদের রচনা পাঠ করেছি। তেমন কিছু বুঝিনি। পশ্চিমাদের লেখা সুফিবাদের বইগুলো জটিলতা বৃদ্ধি করেছে, কমাতে পারেনি।
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে সুফিবাদ বলছে_'I was a Hidden Treasure, so I loved to be known. Hence I created the creatures that I might be known.' [আমি ছিলাম লুকানো রত্ন। নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা হলো। আমি সৃষ্টি করলাম যাতে প্রকাশিত হই।]
সুফিবাদের একটি ধারণা হলো_সৃষ্টিকর্তা মানুষকে করুণা করেন এবং ভালোবাসেন। মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে পারবে কিন্তু করুণা করতে পারবে না। ভালোবাসা দু'দিকেই চলাচল করতে সক্ষম, করুণার গতি শুধুই একমুখী।
একইভাবে মানুষ পশুপাখিকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে। পশুপাখি মানুষকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে না।
বাস্তবতা নিয়ে সুফিদের অনেক বিশুদ্ধ চিন্তা আছে। তাদের চিন্তার সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার কিছু মিল আছে। সুফিরা বলেন, আমাদের দৃশ্যমান জগৎ অবাস্তব। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বাস্তব।
সুফিরা বলেন, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমে আমরা দেখি, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমেই আমরা শুনি।
সুফিদের আরাধনার মূল বিষয়টি আমার পছন্দের। তাঁরা প্রার্থনা করেন-'Show me the things as they are.' [বস্তুগুলো যে-রকম আমাকে সে-রকম দেখাও।] তাঁদের প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বস্তুগুলো যে-রকম দেখছি আসলে সে-রকম না।
মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে আল্লাহপাকের সাক্ষাতের ঘটনার সুফি ব্যাখ্যা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। পাঠকদের সঙ্গে সুফি ব্যাখ্যা ভাগাভাগি করতে চাচ্ছি।
তুর পর্বতের সামনে এই সাক্ষাতের ঘটনা ঘটে। তুর পর্বত কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে মূসা (আ.) মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুফি ব্যাখ্যা হলো, একমাত্র আল্লাহ বাস্তব আর সবই অবাস্তব। কাজেই বাস্তব আল্লাহর উপস্থিতিতে অবাস্তব পাহাড় মিলিয়ে গেল।
আমি কি ধর্মকর্ম বিষয়টা যথেষ্ট জটিল করার চেষ্টা চালাচ্ছি? মনে হয় তাই। সহজিয়া ধারায় চলে আসা যাক। সুফিদের কথা বাদ। নিজের কথা বলি।
ধর্ম নিয়ে আমার আগ্রহ খানিকটা আছে। সিলেট যাব, হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে কিছু সময় কাটাব না তা কখনো হবে না। রাজশাহী যাওয়া মানেই নিশিরাতে শাহ মখদুমের মাজার শরীফে উপস্থিত হওয়া। পাঠকদের হজরত শাহ মখদুম সম্পর্কে একটি অন্যরকম তথ্য দিই। তাঁর জীবনী লেখা হয় ফারসি ভাষাতে। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের আদেশে এই জীবনী ফারসি থেকে বাংলা তরজমা করা হয়। এই বাংলা তরজমা আদি বাংলা গদ্যের নিদর্শন হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রদের পাঠ্য ছিল। বইটি একসময় বাংলাদেশ বুক কর্পোরেশন প্রকাশ করেছিল। আমার কাছে একটি কপি ছিল। বিটিভির নওয়াজেশ আলী খান পড়তে নিয়ে ফেরত দেননি। বইটির দ্বিতীয় কপি জোগাড় করতে পারিনি। (ফাউনটেনপেন লেখায় যাঁরা আমার সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো নিয়ে ফেরত দেননি তাদের নাম প্রকাশ করা হবে। কাজেই সাবধান। আমার আরেকটি প্রিয় গ্রন্থ মিসরের গভর্নরকে লেখা হজরত আলীর চিঠি কালের কণ্ঠের সম্পাদক আবেদ খান পাঁচ বছর আগে নিয়েছেন। এখনো ফেরত দেননি।)
পূর্বকথায় ফিরে যাই। আমি যে শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের মাজারে যাই তা কিন্তু না। যে-কোনো ধর্মের তীর্থস্থানগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ। এই আগ্রহ নিয়েই পাবনা শহরে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে একদিন উপস্থিত হলাম। ইনি কথাশিল্পী শীর্ষেন্দুর ঠাকুর। তাঁর প্রতিটি বইতেই থাকবে র:স্থা যা অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত। শীর্ষেন্দুর জবানিতে_একসময় তিনি জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আত্দহননের কথা চিন্তা করছিলেন। তখন অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। অনুকূল ঠাকুর হাত দিয়ে শীর্ষেন্দুকে স্পর্শ করা মাত্র কিছু একটা ঘটে গেল। শীর্ষেন্দু জীবনের প্রতি মমতা ফিরে পেলেন। তাঁর লেখালেখির শুরুও এরপর থেকেই।
অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায়েতরা আমাকে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করলেন। দুপুরে তাদের সঙ্গে খাবার খেলাম। আশ্রমের প্রধান অনুকূল ঠাকুরের বিশাল এক তৈলচিত্রের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুগ্ধ গলায় বললেন, ঠাকুরের রহস্যটা একটু দেখুন স্যার। আপনি যেখানেই দাঁড়ান না কেন মনে হবে ঠাকুর আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। উত্তরে দাঁড়ান কিংবা পুবে দাঁড়ান, ঠাকুরের দৃষ্টি আপনার দিকে।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, সরাসরি ক্যামেরা লেন্সের দিকে তাকিয়ে আপনি যদি একটি ছবি তোলেন সেই ছবিতেও একই ব্যাপার হবে। সবকিছুতে মহিমা আরোপ না করাই ভালো। সেবায়েত আমার কথায় মন খারাপ করলেও বিষয়টি স্বীকার করলেন।
অনেক বছর আগে নেপালে হনুমানজির মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া সেখানে কেউ যেতে পারবে না। মন্দিরের একজন সেবায়েতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো মানুষটা বুদ্ধিমান। আমি তাঁকে কাছে ডেকে বললাম, ভাই, মন্দিরের কাছে কিছু কুকুর দেখতে পাচ্ছি। ওরা মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে পারবে, আর আমি মানুষ হয়ে যেতে পারব না। এটা কি ঠিক?
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি অবশ্যি শেষ পর্যন্ত যাইনি। কেন জানি হঠাৎ করে মন উঠে গেল।
আমাদের অতি পবিত্র স্থান মক্কা শরীফে অমুসলমানদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমাদের নবীজি (দ.)-এর জীবদ্দশায় অনেক অমুসলমান সেখানে বাস করতেন। কাবার কাছে যেতেন। তাদের ওপর কোনোরকম বিধিনিষেধ ছিল বলে আমি বইপত্রে পড়িনি। ধর্ম আমাদের উদার করবে। অনুদার করবে কেন?
পাদটীকা:
প্রশ্ন: মুসলমান মাত্রই বেতের নামাজের কথা জানেন। তিন রাকাতের নামাজ। বেতের শব্দের অর্থ বেজোড়। এক একটি বেজোড় সংখ্যা। এক রাকাতের নামাজ কি পড়া যায়?
উত্তর: হ্যাঁ যায়।
(আমি মনগড়া কথা বলছি না। জেনেশুনেই বলছি।
আমি এসেছি অতি কঠিন গোঁড়া মুসলিম পরিবেশ থেকে। আমার দাদা মাওলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁর বাবা জাহাঙ্গির মুনশি ছিলেন পীর মানুষ। আমার দাদার বাড়ি 'মৌলবিবাড়ি' নামে এখনো পরিচিত।
ছোটবেলায় দেখেছি দাদার বাড়ির মূল অংশে বড় বড় পর্দা ঝুলছে। পর্দার আড়ালে থাকতেন মহিলারা। তাদের কণ্ঠস্বর পুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ ছিল বিধায় তারা ফিসফিস করে কথা বলতেন। হাতে চুড়ি পরতেন না। চুড়ির রিনঝিন শব্দও পরপুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ। দাদাজান বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন হাততালির মাধ্যমে। এক হাততালির অর্থ-পানি খাবেন। দুই হাততালি-পান তামাক ইত্যাদি।
একবার বড় ঈদ উপলক্ষে দাদার বাড়িতে গিয়েছি। আমার বয়স ছয় কিংবা সাত। দাদাজান ডেকে পাঠালেন। বললেন, কলেমা তৈয়ব পড়।
আমি বললাম, জানি না তো।
দাদাজানের মুখ গম্ভীর হলো। দাদিজান আবার তাৎক্ষণিক শাস্তির পক্ষে। তিনি বললেন, পুলারে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, কলেমা জানে না।
দাদাজান বিরক্তমুখে বললেন, সে ছোট মানুষ। শাস্তি তার প্রাপ্য না। শাস্তি তার বাবা-মা'র প্রাপ্য।
বাবা-মা'র শাস্তি হয়েছিল কি না আমি জানি না। দাদা-দাদির কাছ থেকে মুক্তি পাচ্ছি এতেই আমি খুশি। ছুটে বের হতে যাচ্ছি, দাদাজান আটকালেন। কঠিন এক নির্দেশ জারি করলেন। এই নির্দেশে আমি সব জায়গায় যেতে পারব, একটা বিশেষ বাড়িতে যেতে পারব না। এই বিশেষ বাড়িটা দাদার বাড়ি থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজের মতো দূরে। গাছপালায় ঢাকা সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনে টলটলা পানির দিঘি। আমি অবাক হয়ে বললাম, ওই বাড়িতে কেন যাব না?
দাদিজান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পুলা বেশি কথা কয়। এরে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, মুখে মুখে কথা।
দাদাজান শাস্তির দিকে গেলেন না। শীতল গলায় বললেন, ওই বাড়িতে ধর্মের নামে বেদাত হয়। ওই বাড়ি মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ। দিনের বেলা যাওয়া যাবে। সন্ধ্যার পর না।
আমি ছোটচাচাকে ধরলাম যেন ওই বাড়িতে যেতে পারি। ছোটচাচা বললেন নিয়ে যাবেন। ওই বাড়ির বিষয়ে ছোটচাচার কাছ থেকে যা জানলাম তা হলো_ওই বাড়ি মুসলমান বাড়ি। তবে তারা অন্যরকম মুসলমান। সন্ধ্যার পর পুরুষ মানুষরা নাচে।
ঘটনা কী জানার জন্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। সারাটা দিন ছটফটানির ভেতর দিয়ে গেল। সন্ধ্যা মিলাবার পর ছোটচাচার সঙ্গে ওই বাড়ির বৈঠকখানায় উপস্থিত হলাম। বাড়ির প্রধান শান্ত সৌম্য চেহারার এক বৃদ্ধ আমাকে কোলে নিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ফয়জুরের ছেলে আসছে। ফয়জুরের বড় পুলা আসছে। এরে কিছু খাইতে দাও।
সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় সত্যি সত্যি পুরুষদের নাচ শুরু হলো। ঘুরে ঘুরে নাচ। নাচের সঙ্গে সবাই মিলে একসঙ্গে বলছে 'আল্লাহু আল্লাহু' কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ভেতর মত্ততা দেখা দিল। একজন অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামাল না। সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চক্রাকারে ঘুরে নাচতেই থাকল। ছোটচাচা গলা নামিয়ে আমাকে কানে কানে বললেন, একটা মাত্র পড়েছে। আরও পড়ব। ধুপধাপ কইরা পড়ব। দেখ মজা।
ছোটচাচার কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুপ করে আরো একজন পড়ে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন কিছুই বুঝিনি, এখন মনে হচ্ছে_এরা কি কোনোভাবে সুফিবাদের সঙ্গে যুক্ত? ড্যান্সিং দরবেশ? এদের পোশাক সে রকম না, লুঙ্গি-গামছা পরা মানুষ। কিন্তু নৃত্যের ভঙ্গি এবং জিগির তো একই রকম। ড্যান্সিং দরবেশদের মধ্যে একসময় আবেশ তৈরি হয়। তারাও মূর্ছিত হয়ে পড়ে যান। এখানেও তো তাই হচ্ছে।
সমস্যা হলো বাংলাদেশের অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুফিবাদ আসবেইবা কীভাবে? কে এনেছে? কেন এনেছে? যখন কলেজে পড়ি (১৯৬৬) তখন কিছু খোঁজখবর বের করার চেষ্টা করেছি। এই বিশেষ ধরনের আরাধনা কে প্রথম শুরু করেন? এইসব। উত্তর পাইনি। তাদের একজনের সঙ্গে কথাবার্তার নমুনা দিচ্ছি।
প্রশ্ন: নাচতে নাচতে আপনি দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তখন কী হয়?
উত্তর: ভাবে চইলা যাই।
প্রশ্ন: কী রকম ভাব?
উত্তর: অন্য দুনিয়ার ভাব।
প্রশ্ন: পরিষ্কার করে বলুন।
উত্তর: বলতে পারব না। ভাবের বিষয়।
প্রশ্ন: চোখের সামনে কিছু দেখেন?
উত্তর: ভাব দেখি। উনারে দেখি।
প্রশ্ন: উনারে দেখেন মানে কী? উনি কে?
উত্তর: উনি ভাব।
সুফিবাদের উৎস হিসেবে ধরা হয় নবীজি (দ.)-এর সঙ্গে জিব্রাইল আলায়েস সালামের সরাসরি সাক্ষাতের হাদিস থেকে। একদিন নবীজি (দ.) বসে ছিলেন। মানুষের রূপ ধরে জিব্রাইল আলায়েস সালাম তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বললেন। একটি হলো-নিবেদন (Submission, ইসলাম), আরেকটি হলো বিশ্বাস (Faith, ঈমান), আর তৃতীয়টি হলো সুন্দর কর্মসাধন (Doing the beautiful, Bnmvb)।
প্রথম দুটি ইসলাম এবং ঈমান, ধর্মের পাঁচস্তম্ভের মধ্যে আছে। তৃতীয়টি নেই। এই তৃতীয়টি থেকেই সুফিবাদের শুরু।
সুফিবাদ বিষয়ে আমার জ্ঞান শুধু যে ভাসাভাসা তা নয়, ভাসাভাসার চেয়েও ভাসাভাসা। দোষ আমার না। দোষ সুফিবাদের দুর্বোধ্যতা এবং জটিলতার। সুফি সাধকদের রচনা পাঠ করেছি। তেমন কিছু বুঝিনি। পশ্চিমাদের লেখা সুফিবাদের বইগুলো জটিলতা বৃদ্ধি করেছে, কমাতে পারেনি।
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে সুফিবাদ বলছে_'I was a Hidden Treasure, so I loved to be known. Hence I created the creatures that I might be known.' [আমি ছিলাম লুকানো রত্ন। নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা হলো। আমি সৃষ্টি করলাম যাতে প্রকাশিত হই।]
সুফিবাদের একটি ধারণা হলো_সৃষ্টিকর্তা মানুষকে করুণা করেন এবং ভালোবাসেন। মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে পারবে কিন্তু করুণা করতে পারবে না। ভালোবাসা দু'দিকেই চলাচল করতে সক্ষম, করুণার গতি শুধুই একমুখী।
একইভাবে মানুষ পশুপাখিকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে। পশুপাখি মানুষকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে না।
বাস্তবতা নিয়ে সুফিদের অনেক বিশুদ্ধ চিন্তা আছে। তাদের চিন্তার সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার কিছু মিল আছে। সুফিরা বলেন, আমাদের দৃশ্যমান জগৎ অবাস্তব। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বাস্তব।
সুফিরা বলেন, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমে আমরা দেখি, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমেই আমরা শুনি।
সুফিদের আরাধনার মূল বিষয়টি আমার পছন্দের। তাঁরা প্রার্থনা করেন-'Show me the things as they are.' [বস্তুগুলো যে-রকম আমাকে সে-রকম দেখাও।] তাঁদের প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বস্তুগুলো যে-রকম দেখছি আসলে সে-রকম না।
মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে আল্লাহপাকের সাক্ষাতের ঘটনার সুফি ব্যাখ্যা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। পাঠকদের সঙ্গে সুফি ব্যাখ্যা ভাগাভাগি করতে চাচ্ছি।
তুর পর্বতের সামনে এই সাক্ষাতের ঘটনা ঘটে। তুর পর্বত কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে মূসা (আ.) মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুফি ব্যাখ্যা হলো, একমাত্র আল্লাহ বাস্তব আর সবই অবাস্তব। কাজেই বাস্তব আল্লাহর উপস্থিতিতে অবাস্তব পাহাড় মিলিয়ে গেল।
আমি কি ধর্মকর্ম বিষয়টা যথেষ্ট জটিল করার চেষ্টা চালাচ্ছি? মনে হয় তাই। সহজিয়া ধারায় চলে আসা যাক। সুফিদের কথা বাদ। নিজের কথা বলি।
ধর্ম নিয়ে আমার আগ্রহ খানিকটা আছে। সিলেট যাব, হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে কিছু সময় কাটাব না তা কখনো হবে না। রাজশাহী যাওয়া মানেই নিশিরাতে শাহ মখদুমের মাজার শরীফে উপস্থিত হওয়া। পাঠকদের হজরত শাহ মখদুম সম্পর্কে একটি অন্যরকম তথ্য দিই। তাঁর জীবনী লেখা হয় ফারসি ভাষাতে। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের আদেশে এই জীবনী ফারসি থেকে বাংলা তরজমা করা হয়। এই বাংলা তরজমা আদি বাংলা গদ্যের নিদর্শন হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রদের পাঠ্য ছিল। বইটি একসময় বাংলাদেশ বুক কর্পোরেশন প্রকাশ করেছিল। আমার কাছে একটি কপি ছিল। বিটিভির নওয়াজেশ আলী খান পড়তে নিয়ে ফেরত দেননি। বইটির দ্বিতীয় কপি জোগাড় করতে পারিনি। (ফাউনটেনপেন লেখায় যাঁরা আমার সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো নিয়ে ফেরত দেননি তাদের নাম প্রকাশ করা হবে। কাজেই সাবধান। আমার আরেকটি প্রিয় গ্রন্থ মিসরের গভর্নরকে লেখা হজরত আলীর চিঠি কালের কণ্ঠের সম্পাদক আবেদ খান পাঁচ বছর আগে নিয়েছেন। এখনো ফেরত দেননি।)
পূর্বকথায় ফিরে যাই। আমি যে শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের মাজারে যাই তা কিন্তু না। যে-কোনো ধর্মের তীর্থস্থানগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ। এই আগ্রহ নিয়েই পাবনা শহরে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে একদিন উপস্থিত হলাম। ইনি কথাশিল্পী শীর্ষেন্দুর ঠাকুর। তাঁর প্রতিটি বইতেই থাকবে র:স্থা যা অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত। শীর্ষেন্দুর জবানিতে_একসময় তিনি জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আত্দহননের কথা চিন্তা করছিলেন। তখন অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। অনুকূল ঠাকুর হাত দিয়ে শীর্ষেন্দুকে স্পর্শ করা মাত্র কিছু একটা ঘটে গেল। শীর্ষেন্দু জীবনের প্রতি মমতা ফিরে পেলেন। তাঁর লেখালেখির শুরুও এরপর থেকেই।
অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায়েতরা আমাকে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করলেন। দুপুরে তাদের সঙ্গে খাবার খেলাম। আশ্রমের প্রধান অনুকূল ঠাকুরের বিশাল এক তৈলচিত্রের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুগ্ধ গলায় বললেন, ঠাকুরের রহস্যটা একটু দেখুন স্যার। আপনি যেখানেই দাঁড়ান না কেন মনে হবে ঠাকুর আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। উত্তরে দাঁড়ান কিংবা পুবে দাঁড়ান, ঠাকুরের দৃষ্টি আপনার দিকে।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, সরাসরি ক্যামেরা লেন্সের দিকে তাকিয়ে আপনি যদি একটি ছবি তোলেন সেই ছবিতেও একই ব্যাপার হবে। সবকিছুতে মহিমা আরোপ না করাই ভালো। সেবায়েত আমার কথায় মন খারাপ করলেও বিষয়টি স্বীকার করলেন।
অনেক বছর আগে নেপালে হনুমানজির মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া সেখানে কেউ যেতে পারবে না। মন্দিরের একজন সেবায়েতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো মানুষটা বুদ্ধিমান। আমি তাঁকে কাছে ডেকে বললাম, ভাই, মন্দিরের কাছে কিছু কুকুর দেখতে পাচ্ছি। ওরা মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে পারবে, আর আমি মানুষ হয়ে যেতে পারব না। এটা কি ঠিক?
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি অবশ্যি শেষ পর্যন্ত যাইনি। কেন জানি হঠাৎ করে মন উঠে গেল।
আমাদের অতি পবিত্র স্থান মক্কা শরীফে অমুসলমানদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমাদের নবীজি (দ.)-এর জীবদ্দশায় অনেক অমুসলমান সেখানে বাস করতেন। কাবার কাছে যেতেন। তাদের ওপর কোনোরকম বিধিনিষেধ ছিল বলে আমি বইপত্রে পড়িনি। ধর্ম আমাদের উদার করবে। অনুদার করবে কেন?
পাদটীকা:
প্রশ্ন: মুসলমান মাত্রই বেতের নামাজের কথা জানেন। তিন রাকাতের নামাজ। বেতের শব্দের অর্থ বেজোড়। এক একটি বেজোড় সংখ্যা। এক রাকাতের নামাজ কি পড়া যায়?
উত্তর: হ্যাঁ যায়।
(আমি মনগড়া কথা বলছি না। জেনেশুনেই বলছি।
No comments:
Post a Comment